স্কাইভিউ পার্ক সিটি

শান্তিনগর, ঢাকা-১২১৭

+৮৮০২-৪১০৩২৩৫৩

২৪/৭ গ্রাহক সেবা

admin@islami-sharia.org

আমাদের কাছে বার্তা পাঠান

ইসলাম হচ্ছে দুুনিয়া ও আখিরাতের সর্বাঙ্গীন, সুসমন্বিত, সুবিন্যস্ত, ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থার নাম, যার মধ্যে নেই কোন বক্রতা, বিভ্রান্তি ও অকল্যাণকর কিছু। আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম।
ইসলামী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সূচিপত্র

ইসলামী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী
আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ সা. প্রদর্শিত জীবন পদ্ধতির অনুসরণ এবং এর বিপরীত সমস্ত মত ও পথ পরিহার করে চলাকে ইসলাম বলা হয়। অন্যকথায় দুনিয়া জাহানের প্রভূ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পনের নামই ইসলাম। যারা নিজেদেরকে এভাবে সমর্পণ করে দেয় তাদেরকে বলে মুসলিম। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পাশ্চাত্যের এক শ্রেণির অমুসলিম ইসলামকে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে “মোহাম্মেদানিজম” বলে আখ্যায়িত করে এবং ইসলামে বিশ্বাসী লোকদেরকে “মোহাম্মেদান” বলে সম্বোধন করে। যার অর্থ দাঁড়ায় ইসলাম ধর্মের জনক হচ্ছেন মুহাম্মাদ সা. নামক এক ব্যক্তি এবং এটি হিন্দু ইজম, মার্কস ইজম ইত্যকার ইজমগুলোর ন্যায় একটি ইজম ছাড়া অন্য কিছুই নয়। মূলতঃ ইসলাম অন্যান্য ইজমগুলোর ন্যায় কোন ইজম বা মতবাদ নয়। ইসলাম আদৌ মুহাম্মাদ সা. পূজারী কোন মতাদর্শের নাম নয় যে, তাঁর কুর্ণিশ করলেই মুসলিম হওয়া যাবে। ইসলাম নিছক কোন ধর্মের নামও নয়, নয় কোন তন্ত্র-মন্ত্রের নাম যা মুখস্থ পড়লেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। ইসলাম বৈরাগ্যবাদী কোন ব্যবস্থার নামও নয় যে, লোকালয় থেকে দূরে কোন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে দিনাতিপাত করবেন, যাতে ধর্মের বিধিবিধান স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে পালন করা যায়। ইসলাম বংশানুক্রমিকভাবে আগত কোন রসম-রেওয়াজ, ‘আকীদাহ-বিশ্বাস, চাল-চলন ও রীতি-নীতির নামও নয় যে, তার পূজা করলে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হওয়া যাবে। এছাড়া ইসলাম কোন অসম্পূর্ণ বা একদেশদর্শী ব্যবস্থাও নয়, নয় কোন জড়, স্থবির, গতিহীন ও বন্ধা অনুশাসন। বরং ইসলাম হচ্ছে দুুনিয়া ও আখিরাতের সর্বাঙ্গীন, সুসমন্বিত, সুবিন্যস্ত, ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থার নাম, যার মধ্যে নেই কোন বক্রতা, বিভ্রান্তি ও অকল্যাণকর কিছু। আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। যার ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে এভাবে দিয়েছেন,

إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ

“ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা।”
(সূরাহ আলে ‘ইমরান: ১৯)

মহান আল্লাহ ইসলাম নামক এ আনুগত্যের বিধানকে রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন হযরত মুহাম্মাদ সা. এর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। বিদায় হজ্জ্বের ভাষণদানকালে ‘আরাফাতের ময়দানে তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয় ইসলামী জীবনবিধানকে পরিপূর্ণতা দানকারী আয়াত,

اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নি‘আমত সম্পন্ন করে দিলাম এবং ইসলামকে একমাত্র দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”
(সূরাহ আল-মায়িদাহ: ০৩)

আল্লাহ ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান করে এ পরিপূর্ণ দীনকে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا ادْخُلُوْا فِيْ السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ

“হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসরণ কর না।”
(সূরাহ আল-বাকারাহ: ২০৮)

রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক প্রবর্তিত এ জীবনব্যবস্থা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সাহাবীগণের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ইসলামের বাণী সম্প্রসারিত হয়। এখানে ইসলামের আলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ভাবেই প্রথমে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তীতে ইসলাম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মুসলিম শাসকগণ বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা পালনের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। এছাড়া তাদের শাসনামলে অসংখ্য আওলিয়া কিরামের আগমন পথ প্রশস্ত হয়। তারা সকল শ্রেণির মানুষের কাছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য উপস্থাপন করেন। মুসলিম শাসন সুসংহত করণে তারা কখনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে অস্ত্র ধরেছেন, আবার কখনো নিজেরাই হয়েছেন যুদ্ধের সিপাহসালার। এমনও হয়েছে যে, বিজয়ী সিপাহসালার বিজিত ভূখন্ডের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু জনসমাজে পরিচিত হয়েছেন আওলিয়া হিসেবে। এজন্যই এ এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। শুধু রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একথা সত্য যে, ইসলামের সঠিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অভাবে এদেশের মুসলিমদের মধ্যে তাদের অমুসলিম পূর্ব পুরুষদের অনেক কুসংস্কার, ভ-পীর ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের চালু করা শিরক, বিদ‘আত, প্রতিবেশি অন্যান্য ধর্মের কিছু পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বিভিন্নভাবে কম বেশি চালু রয়েছে। কিন্তু এদেশের অশিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি ভালবাসা এবং মুসলিম হিসেবে জাতীয় চেতনাবোধ এমন প্রবল রয়েছে যে, সকল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও কোন কালেই তা হারিয়ে যায়নি। একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের জনগণ মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ভাবপ্রবণ হবার ফলে কখনো কখনো রাজনৈতিক গ্লোক ধাঁধায় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে বা ভুল করতে পারে, কিন্তু সচেতনভাবে ইসলামী চেতনাবোধ ও মুসলিম জাতীয়তাবোধকে তাদের জীবন থেকে মুছে ফেলতে দেয়নি। আল-কুরআন, রাসূলুল্লাহ সা. ও রাসূলের সুন্নাহ এর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং প্রকাশ্যে অবমাননা করে এদেশে কারো পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। এমনকি ইসলামের কথা না বলে এবং ইসলামের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে এদেশে কারো পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়াও কঠিন। সুতরাং বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত এবং এদেশে ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জল। কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।

‘আলিমগণের মধ্যে বিভ্রান্তি নয়, ঐক্য চাই

‘আলিমগণের মধ্যে বিভ্রান্তি নয়, ঐক্য চাই ‘আলিম হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে জানে, যে জ্ঞান লাভ করে, জ্ঞান অনুসন্ধান করে ও জ্ঞান চর্চা করে। ইসলামের সবচেয়ে বড় ‘আলিম হচ্ছে সেই, যে সবচেয়ে বেশি কুরআন জানে। কারণ কুরআনই হচ্ছে যথার্থ ও নির্ভুল জ্ঞানের প্রধানতম উৎস। কুরআনে যে জ্ঞান পরিবেশন করা হয়েছে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

 ذَالِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ

“এটি সেই কিতাব, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই।”
(সূরাহ আল-বাকারাহ: ২)

কুরআনের জ্ঞান চর্চাকারীকে ইসলামী সমাজে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

“মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিখায়।”
(সহীহুল বুখারী, ফাযাইলুল কুরআন, হাদীস নম্বর: ৪৭৩৯; তিরমিযী, ফাযাইলুল কুরআন, হাদীস নম্বর: ২৯০৮; আবূ দাউদ, আসসালাত, হাদীস নম্বর:১৪৫২)

মহান আল্লাহ বলেন,

هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لا يَعْلَمُوْنَ

“যাদের ইলম আছে এবং যাদের ইলম নেই তারা কি সমান হতে পারে?”
(সূরাহ আয-যুমার: ৯)

মনের মধ্যে আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি করাকে ইসলামে জ্ঞান চর্চার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। জ্ঞান চর্চার পরেও যদি অহমিকা বৃদ্ধি পায়, আত্মঅহমিকার মধ্যে মানুষ ডুবে যায়, তাহলে জ্ঞান চর্চা মানুষের অকল্যাণ ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর আল-কুরআনের জ্ঞান এমন এক সম্পদ, যা মানুষের মনে সত্যিকার আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

 اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

“নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলিমগণই তাঁকে ভয় করে।”
(সূরাহ আল-ফাতির: ২৮)

অন্যকথায় বলা যায়, ইলম অর্জন করার পরেও যাদের মনে যথার্থ আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি হয়নি, দীন ও দুনিয়ার বিভিন্ন কাজ করার ক্ষেত্রে যারা আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সা. এর হুকুম ও শরী‘আতের বিধানের পরোয়া করেনা তারা আসলে আলিম নয়, আলিম নামধারী মাত্র। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 إِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُوْلَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللاَّعِنُوْنَ-إِلاَّ الَّذِيْنَ تَابُوْا وَأَصْلَحُوْا وَبَيَّنُوْا فَأُولَئِكَ أَتُوْبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ

“আমি সেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্য, কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরেও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয়, কিন্তু যারা তাওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, ওরাই তারা যাদের প্রতি আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
(সূরাহ আল-বাকারাহ: ১৫৯-১৬০)

‘আলিমগণ সত্যের আহবায়ক এবং মানবগোষ্ঠীর পথপ্রদর্শক। ইসলাম প্রতিষ্ঠার অগ্রবর্তী বাহিনীর অপরিহার্য অংশ হচ্ছে ‘আলিমগণ। তাদেরকে উপেক্ষা করে সমাজের অন্য কোন গোষ্ঠীর পক্ষে বাংলাদেশের বিবদমান পরিস্থিতিতে ইসলামের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি করা অসম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় কয়েক লক্ষ ‘আলিম রয়েছেন। তারা বিভিন্ন প্রকার দীনী খিদমতে নিয়োজিতও রয়েছেন। কিন্তু তারা সকলে ইকামতে দীনের কাজে সক্রিয় না হওয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বলা যায় দীন প্রতিষ্ঠায় তাদের নিষ্ক্রিয়তা ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রধান অন্তরায়। অবশ্য এর পেছনে কিছু কারণও পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নরূপ:

  • ১. বৃটিশ ভারতের আমল থেকেই আমাদের দেশের আলিম সমাজকে আর্থ-সামাজিকভাবে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে দু’ বার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সে অবস্থার কোন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। ফলে ‘আলিম সমাজের বৃহৎ অংশ নিজেদের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন।
  • ২. বর্তমানে যারা মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মসজিদের ইমামতি, মাদরাসায় শিক্ষকতা, স্কুলের সহকারী মৌলভী হিসেবে শিক্ষকতা, বিবাহ এর কাযী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি। এ দুর্বল মানসিকতার কারণে তাদের মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য বড় কিছুু করার সংকল্প সৃষ্টি হয়না। খুব কম সংখ্যক ‘আলিম রয়েছেন যারা তাদের পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি দীন প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ গ্রহণ করেন।
  • ৩. ‘আলিম সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশকে ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ শ্রেণির ‘আলিমগণ ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে জনমনে বিভ্রান্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তারা শরী‘আত ও মা‘রিফাত এর অপব্যাখ্যা করে কুফরী কাজে লিপ্ত রয়েছে। তারা মনে করে, মা‘রিফাত হাসিল হয়ে গেলে শরী‘আতের প্রয়োজন নেই। এক শ্রেণির ‘আলিম ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে। শিরক-বিদ‘আতসহ সব ধরনের অনাচার ও অনৈসলামিক অপতৎপরতায় লিপ্ত ঐ সমস্ত ধর্ম ব্যবসায়ীরা। মুসলিম নামের কলংক ঐ সমস্ত ‘আলিমগণ যে নিজেদের ঈমান ও আমলের জঘন্য ধরনের বিকৃতি ঘটিয়ে সাধারণ মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করবে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. এর ভবিষ্যতবাণী নিম্নরূপ,

عَنْ أَبِيْ سَعِيدٍن الْخُدْرِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‏ لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوْا فِيْ جُحْرِ ضَبٍّ لاَتَّبَعْتُمُوْهُمْ ‏ قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ آلْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى قَالَ ‏ فَمَنْ

“আবূ সা‘ঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, হে আমার উম্মাত! তোমরা  (তোমাদের মধ্য থেকে একদল ভ্রান্ত লোক) তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের অবশ্যই অনুসরণ করবে বিঘতের সাথে বিঘত মিলিয়ে আর হাতের সাথে হাত মিলিয়ে। অর্থাৎ সমান সমান তাদের কুসংস্কারমূলক ‘আকীদা-বিশ্বাস ও আচার-আচরণের পেছনে ধাবিত হবে। এমনকি তারা যদি গুই সাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তবে তোমরাও তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে গুই সাপের গর্তে পবেশ করবে। আবূ সা‘ঈদ খুদরী রা. বলেন, আমরা তখন প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনি পূর্ববর্তী বলতে ইহুদী-খ্রিস্টানদের কথা বলছেন না কি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তবে আর কার কথা বলছি? আমার উম্মাতের একদল লোক ইহুদী-খ্রিস্টানদের কুসংস্কারমূলক ‘আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মকান্ডে লিপ্ত হবে।”
(সহীহুল মুসলিম, কিতাবুল ‘ইলম, হাদীস নম্বর: ২৬৬৯)

  • ৪. দ্বিমূখী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার কোনটিতেই ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে শিখাবার ব্যবস্থা নেই। শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকেই এখানে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সা. কিভাবে মানবসমাজকে পরিবর্তন করলেন, কুরআন ও রাসূলের জীবন থেকে বর্তমান যুগে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কি করা দরকার- এসব দৃষ্টিভঙ্গিতে মাদরাসায় এখনও ইসলামী শিক্ষা চালু হয়নি। ফলে তারা ইসলামকে কেবল একটি ধর্ম হিসেবেই জানার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ রাসূলুল্লাহ সা. প্রেরীত হয়েছিলেন ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ 

“তিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দীন (জীবনবিধান) সহকারে, যাতে তিনি একে অপরাপর দীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন।”
(সূরাহ আত-তাওবাহ: ৩৩)

  • ৫. আমাদের দেশের তথা গোটা মুসলিম বিশ্বের ‘আলিম-‘উলামা ও পীর-মাশায়েখদের একটি বড় রোগ হচ্ছে তারা ইসলামের বড় বড় বিষয়কে উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে বেশি মত্ত। অথচ বৃহৎ বিষয়গুলো এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলোর প্রতি উদাসীনতা উম্মাহর অস্তিত্ব, আশা-আখাঙ্খা, পরিবেশ তথা সামগ্রিক সত্ত্বাকে বিপন্ন করতে পারে। তথাকথিত এক শ্রেণির ‘আলিম নামের কলঙ্ক সুন্নী-ওহাবী বিবাদ, দেওবন্দী-ব্রেলভী ঝগড়া, মাযহাবী-লামাযহাবী বিরোধকে বাতাস দিয়ে আরো চাঙ্গা করে তুলছে। এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। দাড়ি রাখা ও এর পরিমাপ, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নাড়ানো, পাগড়ীর প্যাচ, দাঁড়িয়ে ও বসে কিয়াম করা ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম বাড়াবাড়ি চলছে। এমন এক সময়ে এসব বিষয় নিয়ে হৈচৈ করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, ইহুদীবাদ ও খ্রিষ্টবাদের নিরবচ্ছিন্ন বৈরিতা ও অনুপ্রবেশের সম্মুখীন। পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায় মুসলিমদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম দা‘ঈগণ চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ‘আলিমগণ যখন নিজেদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে, নফল-মুস্তাহাব নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ও ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত হয় তখন জাতির ভাগ্যাকাশে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সমরখন্দের ‘উলামা ও বিভিন্ন ইসলামী ফিরকার নেতৃবৃন্দের মধ্যে পাগড়ীর কত প্যাঁচ হবে আর টুপির আকার-আকৃতি কেমন হবে এ নিয়ে দীর্ঘ বাহাছ ও সংঘর্ষের কথা। এই যে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ফাসাদ হলো এর শেষ পরিণতি কি তা কারো অজানা নয়। ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র তাশখন্দ, কাশগড়, তিরমিয, সমরখন্দ ও বোখারায় খোদায়ী গজব হিসেবে নেমে এল নাস্তিক্যবাদী শাসন। আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হলো ইসলামী ‘উলূম-ফুনূনের কুতুবখানা, গুড়িয়ে দেয়া হলো মাদরাসা, মসজিদ, হত্যা করা হলো লক্ষ লক্ষ ‘আলিমকে। প্রায় পোনে এক শতাব্দীকাল ব্যাপী জগদ্দল পাথরের মত চেপে রইল কমিউনিস্ট শাসন। সে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু আজো ফিরে আসেনি সেখানে ইসলামের হারানো সুদীন।উম্মতে মুসলিমার মধ্যে নবী-রাসূলগণের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছেন ‘আলিমগণ। কাজেই রাসূলুল্লাহ সা. যে দায়িত্ব পালন করেছেন, সে দায়িত্ব আজ ‘আলিমগণকেই পালন করতে হবে।এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে,
  • ১. রাসূলুল্লাহ সা. কে আল্লাহ সরাসরি যে জ্ঞান দান করেছিলেন, ‘আলিমগণকেও কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে সেই জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
  • ২. রাসূলুল্লাহ সা. যে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলিতে গুণান্বিত হয়েছিলেন ‘আলিমগণকেও সেই চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের একটি শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণ বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ

“তাঁরা কাফিরদের প্রতি অতি কঠোর এবং নিজের মু’মিন ভাইদের প্রতি অত্যন্ত কোমল ও সদয়।”
(সূরাহ আল-ফাতহ: ২৯)

আলিমগণকেও তাই হতে হবে। যারা মাঠে ময়দানে ইসলামের বিরোধিতা করে, যাদের সমগ্র জীবন ইসলাম বিরোধী চিন্তা ও দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, ইসলামী আদর্শের প্রতি যাদের কানাকড়িও বিশ্বাস নেই, ইসলামকে ধ্বংস করাই যাদের জীবনের মূল লক্ষ্য, তাদের প্রতি আলিমগণকে হতে হবে কঠোর। আর যারা ইসলামে বিশ্বাস করে, ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতেই যারা নিজেদের জীবন গড়ে তুলছে, ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করাই যাদের জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য, তাদের সাথে মত ও পথের হাজারো বিরোধ সত্ত্বেও আলিমগণকে হতে হবে কোমল। অর্থাৎ ইসলাম বিরোধীদের সাথে যেখানে মতাদর্শের ক্ষেত্রে কোন আপোশ মনোভাব স্থান পাবেনা সেখানে ইসলাম সমর্থকদের সাথে প্রথম পর্বেই আপোশ মনোভাব হবে মৌলনীতি। আলিমগণ এ নীতি থেকে বিচ্যুত হলে তাঁরা নবীর আদর্শ, চরিত্র, নীতি ও পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন বলে প্রমাণিত হবে।

  • ৩. রাসূলুল্লাহ সা. যে সত্য দীনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রচলিত সমস্ত ধর্ম, মতবাদ ও জীবনাদর্শকে বাতিলের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছেন, আলিমগণকেও সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. প্রবর্তিত দীন আজ মুসলিম দেশ ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত নেই। ভিন্ন মতবাদ, মতাদর্শ ও সভ্যতার রাহুগ্রাসে তার সমগ্র সত্তা আচ্ছন্ন। একে মুসলিম সমাজে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আলিমগণকে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ দায়িত্ব যদি অন্য কেউ পালন করে তাহলে আলিমগণ তাদেরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু অন্যরা এ ময়দানে সংগ্রাম ও সাধনায় প্রবৃত্ত হলে আলিমগণ তাদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখবেন এটা আলিমগণের দায়িত্ব পালন নয়, দায়িত্বের প্রতি অবহেলা ও দুনিয়ার স্বার্থের মোহ হিসেবে গণ্য হবে। বর্তমান সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদেরকে যখন কোনঠাসা করার জন্য সকল অমুসলিম শক্তি ষড়যন্ত্র করছে, টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ী, নারী তথা যাকে যা দিয়ে পারছে মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের হাক্কানী উলামা-মাশায়েখ, আয়িম্মা-খুতাবা এক কথায় কুরআন-সুন্নাহর প্রতি আনুগত্যশীল সমস্ত মুসলিমদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার না করে, কুৎসা রটনা না করে, হেয় অপদস্ত না করে, পরস্পর কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি না করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। ছোটখাট মুস্তাহাব, মুস্তাহসান নিয়ে যুগ যুগ ধরে যে মতভেদ চলে আসছে এবং এ সবের কারণে মুসলিমদের মধ্যে যে তিক্ততা বিরাজ  করছে সেটি পরিহার করে সকলে মিলে ইসলামের মূল বুনিয়াদের উপর এক প্লাটফরমে একত্রিত হতে হবে। কারো পীর কেবলা, কারো দাদা পীর, কারো নানা পীর কে কি বলেছেন সেটি দলীল হিসেবে গণ্য হয়না, একথা সকল হাক্কানী আলিমই ভালভাবে জানেন। এরপরেও দেশের উলামা-মাশায়েখ ফেতনায় জড়িয়ে পড়বেন এ ভয়ে চুপ করে থাকার কারণে যারা শুদ্ধ করে পবিত্র কুরআনের একটি সূরাহ পড়তে পারেনা, অর্থ ও ব্যাখ্যাতো দূরের কথা, তারাই সাধারণ মানুষকে কাশ্ফ ও ইলহামের নামে ভুয়া কিরামতির মাধ্যমে বিপথগামী করছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বহু সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী উচ্চ শিক্ষিতদেরকেও পথভ্রষ্ট করে চলছে। ইসলামের মূলনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং আজ ঐ সমস্ত আলিম ও পীর সমাজকে সত্যের পতাকা নিয়ে মাঠে নামা প্রয়োজন, যারা নিজেরা দাবী করেন যে তাদের হাজার হাজার মুরীদ-মু‘তাকিদ আছে। অথচ বাংলাদেশের এ দুর্দিনে তাদেরকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া দেশে মাযহাবী ফিরকাবন্দী যে চেহারায় আত্মপ্রকাশ করছে, তা দূর করার জন্য দেশের বড় বড় ফকীহ ও ইসলামী আইন বিশারদদের সমন্বয়ে একটি “ইসলামী ফিক্হ একাডেমি” গঠন করা প্রয়োজন। এ একাডেমি যে আইন প্রণয়ন করবে স্বাভাবিকভাবে তাতে মুসলিম জনগণের সম্মিলিত চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে। আর এ যুগে যখন ইজতিহাদের পক্ষে আওয়াজ বুলন্দ হয়েছে, তখন ব্যক্তিগত ইজতিহাদের পরিবর্তে সম্মিলিত ইজতিহাদের উপরই বেশি জোর দেয়া উচিৎ এবং এটিতে কম রিস্ক বলে মনে হয়। শরী‘আতের কোন প্রসঙ্গে যুগের ফকীহদের ইজমা বা সর্ব সম্মিলিত রায় সেই প্রসঙ্গটি মেনে নেয়া সবার জন্য ওয়াজিব গণ্য করে। যতক্ষণ অন্য একটি ইজমা এসে এটিকে রহিত না করে দিবে ততক্ষণ এর কার্যকারিতা বহাল থাকবে।“ইসলামী ফিক্হ একাডেমি” কে নিম্নলিখিত বিষয়ের আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন,
  • ১. মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সা. এর সুন্নাতের ভিত্তিতে যে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
  • ২. ফতোয়ার ভিত্তি কোন একটি বিশেষ ফিক্হের উপর স্থির না রেখে ফিক্হের যে উসূল ও দলীল-প্রমাণ কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের অধিকতর নিকটবর্তী হবে এবং আধুনিক যুগের দাবী পূরণ করার ক্ষমতা যার মধ্যে বেশি থাকবে তাকেই গ্রহণ করতে হবে।
  • ৩. ‘ইবাদাত সম্পর্কিত মাসাইলের পরিবর্তে মু‘আমিলাত সম্পর্কিত মাসাইলের ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করা। যেমন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আধুনিক অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, শিল্প-কারখানা, কৃষি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ।
  • ৪. আধুনিক টেকনোলজির কারণে যেসব নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেমন একজনের অঙ্গ আরেকজনের শরীরে স্থাপন করা, টেস্ট টিউব বেবীর বৈধতা ও তার বৈধ বংশ নির্ণয় এবং মীরাছের সমস্যা, চিত্র নির্মাণ, সিনেমা ইত্যাদি বিষয়ে শরী‘আতসম্মত রায় দিতে হবে।
  • ৫. ফিক্হ একাডেমির সকল গবেষণাকর্মকে অবশ্যই রাজনৈতিক বিরোধের উর্ধ্বে রাখতে হবে।

ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে বিদ্বেষ নয়, বন্ধুত্ব চাই

ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে বিদ্বেষ নয়, বন্ধুত্ব চাই, মুসলিম জাতি একটি সেতু সাদৃশ্য। কোন সেতুর একটি স্তম্ভ ভেঙ্গে গেলে যেমন সমগ্র সেতুটি দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়ে ঠিক মুসলিম জাতির ঐক্য বিনষ্ট হলে পতনোম্মুখ সেতুর ন্যায় মুসলিমরাও দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍْ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ؛ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى

“নু‘মান ইব্ন বাশীর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ঈমানদারদগণ পারস্পারিক বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ও দয়ার ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায়। দেহের কোন একটি অঙ্গে যদি ব্যথা পায় তাহলে শরীরের সকল অঙ্গ প্রতঙ্গ এর জন্য জাগরণ ও জ্বরের মাধ্যমে তার ব্যথায় সহ অংশীদার হয়।”
(সহীহুল বুখারী, হাদীস নম্বর: ৬০১১ ও সহীহুল মুসলিম, হাদীস নম্বর: ২৫৮৬)

মুসলিম জাতির ধ্বংস, বিপর্যয় ও বিপদ অনৈক্যের মাঝেই নিহিত। হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন, ফার্ডিনেন্ডের হাতে স্পেনের পতন, লর্ড ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন ইত্যাদি ছিল মুসলিমদের কলহ, বিভেদ ও অনৈক্যের অনিবার্য ফলশ্রুতি। ক্রসেড যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাজা রিচার্ড গাজী সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর নিকট নিবেদন করেছিল, সালাহদীন! আমাকে একবার জেরুজালেমে প্রবেশ করতে দিন। সালাহুদ্দীন ভদ্রচিতভাবে সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিংহ হৃদয় রিচার্ড! এমন আবেদন করে আমকে বিব্রত করবেন না। আমি শপথ করেছি, আর কোন দিন সেখানে খ্রিস্ট শক্তিকে প্রবেশ করতে দেব না। অত্যন্ত ব্যাথাতুর মন নিয়ে রাজা ফিরে গিয়েছিলেন নিজ দেশে। কিন্তু খ্রিস্টজাতি সে অপমান যন্ত্রনা ভুলতে পারেনি। গুপ্তচর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বুনে বিভেদের বীজ। উস্কে দেয় আঞ্চলিকতা ও ভাষাগত বিরোধ। নীলনকশা অনুযায়ী খিলাফতের ভিত করে তোলে নড়বড়ে। এক পর্যায়ে মুসলিমদেরই একদল খ্রিস্টান বাহিনীকে ডেকে আনে সিরিয়ায়। দামেস্ক ও জেরুজালেমে প্রবেশ করে ইউরোপীয় জেনারেলরা। বৃটিশ জেনারেল এলেন বি পবিত্র নগরী জেরুজালেমে প্রবেশ করে নির্মমভাবে হত্যা করে তুর্কী মুসলিমদের। আর দম্ভ করে বলে, আজ বদলা নিলাম ক্রসেডের। অপর এক খ্রিস্টান জেনারেল দামেস্কে প্রবেশ করে উমাইয়া মসজিদের পাশে সালাহুদ্দীনের কবরের উপর লাথি মেরে বলে, দ্যাখো সালাদীন! আমরা আবার এসেছি। এ গ্লানিকর ইতিহাসের শেষ নেই। বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামী শক্তিগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে সীমাহীন অনৈক্য। খালেছ দীনী অনুভূতির অনুপস্থিতিই অনৈক্য সৃষ্টির মূল কারণ। প্রত্যেকেই নিজ দলীয় আদর্শকে সঠিক ও অন্যান্যদের আদর্শকে বাতিল, গোমরাহ ও ফিরকাহ মনে করেন।  এ ধরনের চরমপন্থা ও গোঁড়ামির কারণে প্রত্যেকেই তার লক্ষ্যপানে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছেন। দীনের ব্যাপারে মতভেদ থাকা দোষণীয় নয়। কিন্তু দীনের দোহাই দিয়ে একদল অন্যদলকে কাফির বলে গালি দেয়া, গোমরাহ বলে ফতোয়া দেয়া কোন প্রকৃত দা‘ঈর পরিচয় বহন করে না। যারা এ কাজ করছেন তারা মূলত জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ এর পরিবর্তে ফাসাদ ফী সাবীলিল্লাহ এর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

মুসলিম উম্মাহ ইসলামী আদর্শের রক্ষক। ইসলামী আদর্শ তখনই বাস্তবায়িত হতে পারে যখন মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত হবে। বিচ্ছিন্নতা তাদের মধ্যে কেবল ফিতনা ও বিপর্যয়ই সৃষ্টি করবে। বিচ্ছিন্নতার সুযোগে যে কোন লোক মুসলিমদেরকে ফিতনা ও গুমরাহীতে নিমজ্জিত করে দিতে পারে। এজন্যই ঐক্যের প্রতি ইসলাম অস্বাভাবিক গুরুত্বারোপ করেছে। কেবল বিশৃংখল না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতেই ইসলাম মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেয়নি, বরং সে সাথে তারা কিসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে, কিভাবে ঐক্য অক্ষুণ্য ও মজবুত রাখবে তাও বলে দিয়েছে।

মুসলিমদের শক্তির ভিত্তি দু’টি মূলনীতির উপর নির্ভর করে। আর তা হলো আল-কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ।

এ মূলনীতির আলোকে নিম্নোক্ত বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে,

  • ১. মহান আল্লাহকে ভয় করা বা তাকওয়া অবলম্বন করা।
  • ২. পরস্পর ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এ দু’টি বিষয়ের প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُمْ مُّسْلِمُوْنَ

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ তেমনিভাবে তাকে ভয় করতে থাক। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করনা।”
(সূরাহ আলে ‘ইমরান: ১০২)

তাকওয়া শব্দের অর্থ বেঁচে থাকা, বিরত থাকা এবং ভয় করা। মহান আল্লাহকে ভয় করে তাঁর দেয়া আইন তথা আদেশ, নিষেধবাণীসমূহের সীমা যথাযথ মেনে চলা, এ ব্যাপারে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাবধান ও সতর্ক থাকাকেই তাকওয়া বলা হয়। এ সাবধানতা অবলম্বনকারীদেরকে মুত্তাকী বলা হয়। দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণের উৎস হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া হলো গোটা শরী‘আতের উদ্দেশ্যে সকল ওহী বা প্রত্যাদেশের লক্ষ্য, সমস্ত আম্বিয়া কিরামের দা‘ওয়াত ও শিক্ষাসমূহের কেন্দ্রবিন্দু। তাকওয়া মানুষের জৈবিক ও নৈতিক জীবনের হিফাজতকারী, প্রতিটি জিনিসের অস্তিত্ব ও উন্নতির রক্ষাকবচ। আল্লাহর বিধানসমূহ মেনে চলার ব্যাপারে মুত্তাকীদের পরিচয় তিনি আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তুলে ধরেছেন। দুনিয়ার ভুল চিন্তা-দর্শন, ভুল কাজ-কর্ম ও আখিরাতে আল্লাহর আযাব থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশা করাই তাকওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ

“হে মানবজাতি! ‘ইবাদাত কর তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা। এভাবেই তোমরা নিষ্কৃতি লাভের আশা করতে পার।”
(সূরাহ আল-বাকারাহ: ২১)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ

“হে মানবজাতি! তোমাদের রবের গযব থেকে বাঁচো। আসলে কিয়ামতের প্রকম্পন বড়ই (ভয়ঙ্কর) জিনিস।”
(সূরাহ আল-হাজ্জ: ১)

আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সা. এর বিধানকে নিজ মতামতের উর্ধ্বে স্থান দেয়াকেও তাকওয়া বলা হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لا تُقَدِّمُوْا بَيْنَ يَدَيِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।”
(সূরাহ আল-হুজুরাত: ১)

রাসূলের সামনে নিজের কণ্ঠস্বর নিচু রাখাও তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ الَّذِيْنَ يَغُضُّوْنَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ امْتَحَنَ اللهُ قُلُوْبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيْمٌ

“যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের কণ্ঠস্বর নিচু রাখে তারাই সেসব লোক, আল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও বড় পুরস্কার।”
(সূরাহ আল-হুজুরাত: ৩)

যে সমস্ত কাজ থেকে আল্লাহ তা‘আলা বেঁচে থাকতে বা বিরত থাকতে বলেছেন, সেগুলো অবশ্যই ভয়ের বিষয়। কারণ সেগুলো থেকে বিরত না থাকলে আল্লাহ তা‘আলার কঠিন শাস্তির সম্মুখীন অবশ্যই হতে হবে। যেমন, কুফর, র্শিক, মিথ্যা, হিংসা, পরনিন্দা ইত্যাদি যে বিষয়গুলো কুরআন ও হাদীস নিষেধ করেছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অপছন্দ সমস্ত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর হলো প্রত্যেক কাজে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা। অন্তরকে আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আল্লাহকে স্মরণ ও সন্তুষ্টির কামনার দ্বারা পরিপূর্ণ রাখা।বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যের প্রয়োজন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন,

 أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ 

“তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং এ বিষয়ে মতবিরোধ কর না।”
(সূরাহ আশ-শূরা: ১৩)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

 –وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا

“তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে মজবুতভাবে ধরে থাক এবং পরস্পর দলাদলিতে লিপ্ত হয়োনা।”
(সূরাহ আলে ‘ইমরান: ১০৩)

আল্লাহর রজ্জু বলতে তাঁর দীনকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর দীনকে রজ্জুর সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে, এটি এমন একটি সম্পর্ক যা একদিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদারদের সম্পর্ক জুড়ে দেয় এবং অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদারদেরকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে একে সংঘবদ্ধ করে। এ রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মানে হচ্ছে, মুসলিমরা দীনকেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করবে, তাঁর ব্যাপারেই আগ্রহ পোষণ করবে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে এবং তারই খিদমত করার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। যেখানেই মুসলিমরা দীনের মৌলিক শিক্ষা ও দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং তাদের সমগ্র দৃষ্টি ও আগ্রহ ছোটখাট ও খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তাদের মধ্যে সে একই প্রকারের দলাদলি ও মতবিরোধ দেখা দিবে, যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীর উম্মতদেরকে তাদের আসল জীবন উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে দুনিয়া ও আখিরাতের লাঞ্ছনার আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

 وَلاَ تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ 

“তোমরা যেন তাদের মত হয়ে যেয়োনা, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরেও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে।”
(সূরাহ আলে ‘ইমরান: ১০৫)

এখানে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের এমন সব উম্মাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা সত্য দীনের সরল ও সুস্পষ্ঠ শিক্ষালাভ করেছিল, কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর দীনের মৌলিক বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে দীনের সাথে সম্পর্ক বিহীন গৌণ ও অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলির ভিত্তিতে নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। এরপর অবান্তর ও আজেবাজে কথা নিয়ে এমনভাবে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহ তাদের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার কথাই তারা ভুলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাস ও নৈতিকতার সে সব মূলনীতির উপর আসলে মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তার প্রতি কোন আগ্রহই তাদের ছিল না। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَأَطِيْعُواْ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَلاَ تَنَازَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ وَاصْبِرُواْ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ

“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ কর না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে। সবরের পথ অবলম্বন কর, অবশ্যই আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।”
(সূরাহ আল-আনফাল: ৪৬)

এ আয়াতেও দেখা যায়, ঈমানদারদের ঐক্যের আসল ভিত্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। এরপর বলা হয়েছে যে, তোমরা পরস্পর বিভেদে লিপ্ত হয়ো না। এর কারণ হলো, বিভেদই দুর্বলতার জন্ম দেয় এবং বিরোধিরা যখন তোমাদের মধ্যে বিভেদ আছে বলে উপলব্ধি করতে পারে তখন তাদের অন্তরে তোমাদের প্রভাব শেষ হয়ে যায়।সবারই আকাঙ্খা ঐক্য। সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ঐক্যের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। পৃথিবীতে এমন একটি লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে যুদ্ধবিগ্রহ, বিবাদ, বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিকতাকে ভালবাসে এবং উপকারী মনে করে। সকলেরই এক ডাক, এক আহবান আর সেটি হল ঐক্য। ঐক্যের উপকারিতা সম্পর্কে সবাই একমত। এরপরেও মানুষ স্বার্থের কারণে বিভিন্ন দল, উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। দলের ভেতরে উপদল, সংগঠনের ভেতরে উপসংগঠন প্রতিটির পেছনেই রয়েছে স্বার্থপরতা। সাময়িক কোন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কিছু দিনের জন্য হয়তবা ঐক্য গড়ে তোলে, আবার স্বার্থোদ্ধার হয়ে গেলেই ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। পরস্পর শত্রুতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মহান আল্লাহ একতা, শৃঙ্খলা ও দলবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ প্রদানের সাথে সাথে এর একটি মূলনীতিও ঘোষণা করেছেন। কারণ কিছু লোককে মস্তিষ্ক নিঃসৃত কোন পরিকল্পনা বা মূলনীতি জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিকট থেকে ঐক্য কামনা করা যায় না। কেবল আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনার মাধ্যমেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর সে বিজ্ঞজনোচিত মূলনীতিই হলো আল্লাহ তা‘আলার দীন। আল্লাহর প্রেরিত জীবনব্যবস্থা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আল-কুরআনকে সম্মিলিতভাবে ধারণ করলে শয়তান তাদের কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। মুসলিম জাতির শক্তি সুদৃঢ় ও অজেয় হবে।

  • ৩. রাসূলুল্লাহ সা. এর সুন্নাহকে মজবুতভাবে ধারণ করা। রাসূলুল্লাহ সা. যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি নিজেই ছিলেন উম্মাতে মুসলিমার ঐক্যের প্রতীক। ইসলামী মিল্লাতের সদস্যদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে চলে আসতেন। সে ব্যাপারে তাঁর রায়কেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিতেন। এভাবেই সকল মতবিরোধ ও অনৈক্যের অবসান ঘটতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. আজ পৃথিবীতে বর্তমান নেই। বর্তমান রয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ সা. এর সন্নাহ। এজন্য কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতির আলোকেই উম্মাতে মুসলিমার ঐক্য অটুট রাখতে হবে। এটিই হচ্ছে ঐক্যের মানদ- এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

مالك بن أنس – رحمه الله – : بَلَغَهُ ، أَنَّ رسولَ الله – صلى الله عليه وسلم – قال : «تَركْتُ فيكُمْ أَمْرَيْنِ لنْ تَضِلُّوا ما تَمسَّكْتُمْ بهما : كتابَ الله ، وسنّة رسولِهِ». أَخرجه الموطأ

“মালিক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন যে, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা এ দুটিকে শক্তভাবে ধারণ করবে ততদিন তোমরা বিভ্রান্ত হবে না। আর সে দুটি হলো, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।”
(মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নম্বর: ১৬৬১)

এর মধ্যে কুরআনকে রাসূলুল্লাহ সা. নিজেই অবিকৃতভাবে সংকলন করে গেছেন। তাঁর সুন্নাহ সংকলনের ব্যাপারে সাহাবা, তাবি‘ঈ, তাবি‘তাবি‘ঈন চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাদের ও প্রতি যুগের উম্মাতের সতর্ক প্রহরীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আল্লাহর ইচ্ছায় এ দুটি আজো অবিকৃত রয়ে গেছে। ফলে উম্মাতের অভ্যরীণ ঐক্যের যাবতীয় সরঞ্জাম হাতের কাছেই মওজুদ রয়েছে। এ দুটি থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং এদের স্বার্থদুষ্ট ব্যবহার ছাড়া উম্মাতের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই।মিল্লাতের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক হচ্ছে খিলাফত। রাসূলুল্লাহ সা. এর পরে খিলাফতে রাশিদা মিল্লাতকে এক সূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। খিলাফতে রাশিদা “খিলাফত ‘আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ” (রাসূলুল্লাহ সা. এর পথানুসারী নিখুঁত ইসলামী খিলাফত) হবার কারণে মিল্লাতের রাজনৈতিক ঐক্যের সাথে সাথে তাদের দীন ও অভ্যন্তরীণ ঐক্যেরও ধারক ছিল। খিলাফতে রাশিদার পর যে বংশভিত্তিক রাজতান্ত্রিক শাসন শুরু হয়, ইতিহাসে সেটি খিলাফত নামে আখ্যায়িত হয়ে এলেও আসলে সেটি “খিলাফত ‘আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ” ছিলনা। এ খিলাফত কেবল মিল্লাতের রাজনৈতিক ঐক্যের পতাকাই বহন করতে সক্ষম হয়েছে। খিলাফতে রাশিদার মাত্র পাঁচ-ছয়শো বছরের মধ্যে তাতারী আগ্রাসন মিল্লাতের এ রাজনৈতিক ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এরপর নিছক কা‘বা কেন্দ্রীকতার কারণেই উম্মাতের এ রাজনৈতিক ঐক্যটি নামকাওয়াস্তে জীবিত ছিল। আধুনিককালে তুরস্কের উসমানী খিলাফত ছিল এরই প্রতীক। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী খিলাফতের অবসান ঘটায় উম্মাতে মুসলিমার ঐক্যের শেষ প্রতীকটুকুও নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়। তুর্কী খিলাফতের শেষের দিকে মিল্লাতে ইসলামিয়ার রাজনৈতিক ঐক্যের ডাক দিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় করেন মিল্লাতের অগ্নীপুরুষ জামালুদ্দীন আফগানী। আফগানীর ডাক উপমহাদেশে এবং বাংলার বুকেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা উপমহাদেশের মুসলিমদের মনে চরম আঘাত হেনেছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিমরা ছিল বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এ সময় আরব বিশ্বে এবং ভারত উপমহাদেশে কিছু ইসলামী শক্তি মিল্লাতে ইসলামিয়ার মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। মিল্লাত দেখতে পায় তার অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক ঐক্যের নতুন মনযিল। মাত্র দু’ তিন যুগের মধ্যে এ শক্তিগুলো সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়ার যেখানেই মুসলিমদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা রয়েছে আজ সেখানেই ইসলামী শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে।ভারতের মযলুম মুসলিমগণ ইন্দিরা গান্ধীর দাপটের সময় সকল ইসলামী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ তিন দফা দাবী আদায়ের জন্য “মাজলিসে মুশাওয়ারাত” (পরামর্শ সভা) নামে ঐক্যমঞ্চে সমবেত হয়।

দাবীগুলো হচ্ছে: 

  • ১. মুসলিম পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
  • ২. উর্দু ভাষাকে শাসনতন্ত্রে দেয়া মর্যাদায় বহাল রাখতে হবে।
  • ৩. আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া যাবে না। ইন্দিরা সরকার মুসলিম শক্তির ঐক্যবদ্ধ আওয়াজকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। মাজলিসে মুশাওয়ারাতের দু’ তিনটি সম্মেলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুসলিমদের মধ্যে এমন চেতনা সৃষ্টি করে যে, সরকার শেষ পর্যন্ত ঐ ষড়যন্ত্র স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। মাওলানা মুফতী মাহমূদুর রহমানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের উদ্যোগে “পাকিস্তান ন্যাশনাল এলায়েন্স” (পিএনএ) বা পাকিস্তান জাতীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। এক সময় মুফতী মাহমূদের দলটি জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু মত পার্থক্য সত্ত্বেও ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে মুফতী মাহমূদ ও মাওলানা মওদূদীর মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ, এয়ার মার্শাল আজগর খান, ওয়ালী খান তাদের দলবলসহ পিএনএ তে যোগদান করে নেজামে মুস্তাফা বা ইসলামী শাসনের আওয়াজ তুলেন। ভুট্টো শাসনের দুর্দিনে এ ঐক্যজোট ব্যতীত পাকিস্তানে ইসলামের মুক্তি অসম্ভব ছিল। ইসলামের প্রাথমিক প্রাধান্য সৃষ্টি হবার পর পিএনএ পরবর্তীকালে কোন শক্তি হিসেবে গণ্য না হলেও ইসলামের এ প্রাধান্যটুকু ঐ ঐক্যজোটেরই অবদান। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। ইসলামী শক্তিগুলোর বিভিন্ন গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ বা সমঝোতার ভিত্তিতে জনগণের সামনে হাজির হলে তারা যত ব্যাপক সাড়া পাবে, বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য নিয়ে হাজির হলে ততটা সাড়া পাবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামী শক্তিগুলোর প্রতি জনগণের আশানুরূপ সাড়ার যে অভাব পরিলক্ষিত হয়, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঐক্যের অভাব। কোন দলের একার পক্ষে একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। বরং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যেমন অধিকতর গতি পাবে তদ্রুপ বাঁধার মোকাবেলায়ও অধিক শক্তিশালী প্রমাণিত হবে। তাই ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে ঐক্য বাংলাদেশের ইসলাম প্রিয় জনতার অত্যন্ত জনপ্রিয় দাবী। সকল ইসলামী শক্তির সমন্বয়ে ঐক্য গড়ে উঠলে সবার মধ্যেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে।

এ ধরনের ঐক্যের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে, 

  • ১. ইসলামী শক্তিগুলোর আমীর বা সভাপতিদের দ্বারা একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিকে ঐক্যমঞ্চের “সভাপতি ম-লী” বলা হবে। কোন এক ব্যক্তি এর সভাপতি হবেন না। প্রতিনিধিদের সকলেই সভাপতি হিসেবে গণ্য হবেন এবং যখন এ কমিটি প্রোগ্রামে বসবে, তখন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক দলের বা গ্রুপের আমীর বা প্রতিনিধিগণ পর্যায়ক্রমিকভাবে সভাপতিত্ব করবেন। প্রোগ্রামের বাইরে তিনি ঐক্যমঞ্চের সভাপতি বিবেচিত হবেন না। এভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হলে ঐক্যমঞ্চে কোন এক ব্যক্তির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং কারো মধ্যে আত্মসম্মানবোধের ঘাটতিও পরিলক্ষিত হবে না। অবশ্য যখন কোন সম্মেলন হবে তখন সকলকেই এমনভাবে মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সভাপতি ম-লীর সবাই গুরুত্ব পান। এভাবে নেতৃত্বের কোন সমস্যা হওয়া থেকে ঐক্যমঞ্চকে রক্ষা করা যেতে পারে।
  • ২. ঐক্যের জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা।
    এর উদ্দেশ্য নিম্নোক্ত হতে পারে,
  • ১. দেশের স্বার্থ বিরোধী যে কোন সিদ্ধান্ত ও ষড়যন্ত্র ঐক্যমঞ্চ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবেলা করবে এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে।
  • ২. ইসলামী বিধান সম্পর্কে ঐক্যমঞ্চের সকলের মধ্যেই যে সব বিষয়ে কোন মতভেদ নেই সে বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে, যাতে মুসলিম জনসাধারণ সঠিক হিদায়াত পায়। এর ফলে শিরক, বিদ‘আত ও ইসলাম বিরোধী রসম রেওয়াজের প্রচলন কমতে থাকবে এবং বাস্তব জীবনে ইসলামকে অনুকরণ করার প্রেরণা বাড়বে।
  • ৩. দেশের সরকার যা কিছু করছেন তা ইসলামের দৃষ্টিতে বিবেচনা করে সঠিক বক্তব্য পেশ করা, যাতে সরকার ভুল করলে নিজেদেরকে সংশোধন করার সুযোগ পায়। এ ধরনের একটি প্লাটফরম থেকে ইসলামের যে রায় প্রকাশ করা হবে তার বিপরীত কাজ করা সরকার অত্যন্ত কঠিন মনে করবে।
  • ৪. দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসলামের বিপরীত কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য ঐক্যমঞ্চের সুচিন্তিত অভিমত যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে করাচিতে আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভীর সভাপতিত্বে সকল মহলের ৩১ জন আলিম সর্বসম্মতভাবে ২২ দফা মূলনীতি প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন। সম্মেলনে যোগদানকারী ৩১ জন আলিমের মধ্যে ৪ জন শি‘আ আলিমও ছিলেন। এতে হানাফী ও আহলে হাদীসের পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব ছিল। 
  • ৫. ইসলামী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা ও কটাক্ষ না করে যুগপৎ কর্মসূচী চালিয়ে যাবে। হটকারিতা, চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি পরিহার করবে। এক দল অপর দলকে শত্রু নয়; বন্ধু হিসেবে বরণ করে নিবে।  
  • ৬. ঐক্যমঞ্চ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। প্রত্যেক দলের পূর্বের নির্বাচনী ফলাফল ও বর্তমান গণভিত্তির আলোকে আলোচনা সাপেক্ষে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে।
  • ৭. নির্বাচনে সকল দলের জনশক্তি স্থানীয় প্রার্থীর পক্ষে নিঃসংকোচে প্রচারণা চালাবেন।
  • ৮. ঐক্যমঞ্চ মনে করলে দেশপ্রেমিক কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারে। 
  • ৩. কেন্দ্রীয় কমিটি তার সকল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করবে। যুগপৎ আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এখান থেকে ব্যয় করা হবে। তবে জাতীয় পর্যায়ের যে কোন ধরনের সভা-সমাবেশ অথবা মিছিলে জনশক্তি উপস্থিত করা বাবদ যাবতীয় খরচ স্ব স্ব দল বহন করবে।
  • ৪. কোন একজন ইসলামী ব্যক্তিত্ব গণমাধ্যমে খোলা চিঠি প্রকাশের মাধ্যমে এ ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। তিনি ঐক্যমঞ্চের আহবায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তিনি আরো দু’জন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করবেন। এ কমিটি প্রত্যেক দল বা গ্রুপের সাথে আলোচনা করে ঐক্যমঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আহবায়ক কমিটির যাবতীয় খরচ পরবর্তীতে ঐক্যমঞ্চ প্রদান করবে।
    পরিশেষে বলতে চাই আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য, উম্মাতে মুহাম্মাদীর হক আদায়ের জন্য, ঈমানের দাবী পূরণের জন্য, সর্বোপরি আখিরাতের মুক্তির জন্য ‘আলিম-‘উলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী শক্তিসমূহের নেতৃবৃন্দকে সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই সম্ভব এদেশে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং এ সম্ভাবনাকে কোন শক্তিই প্রতিহত করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর শাশ্বত বাণী হচ্ছে, 

وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا 

“যারা আমার পথে এগিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব।”
(সূরাহ আল-‘আনকাবূত: ৬৯)‎ 

এখানে মন্তব্য করুন

লেখক পরিচিতি

নামঃ ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী।
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
বি. এ (অনার্স), (১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষ),
এম. এ, (১৯৯৯ শিক্ষাবর্ষ),
পিএইচ.ডি, (২০০৬ শিক্ষাবর্ষ),
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
পেশাঃ সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০১৭১৮ -৫৭৭১২২
ই-মেইলঃ dfas122@gmail.com

আমাদের অনুসরণ করুন

সর্বশেষ ইউটিউব ভিডিও

Play Video

সাম্প্রতিক পোস্ট