কুরবানী একটি ইবাদত এবং এটি শিয়ারে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত আর কুরবানীর মূল কথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য এটি বিশেষ জরুরী।
কুরবানী ওয়াজিব বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসয়ালা

সূচিপত্র

কুরবানী ওয়াজিব বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসয়ালা

কুরবানী একটি ইবাদত এবং এটি শিয়ারে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত আর কুরবানীর মূল কথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য এটি বিশেষ জরুরী। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পন্ন করা। এখানে কুরবানীর কিছু জরুরি মাসায়েল উপস্থাপিত হলো;

কুরবানীর প্রকারভেদ;

(১) ওয়াজিব কুরবানী
ক) সাহিবে নিসাবের কুরবানী
খ) মান্নতের কুরবানী
গ) দরিদ্র ব্যক্তি কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে ফেললে
(২)নফল কুরবানী
ক) মুসাফির ব্যক্তির কুরবানী
(সাহেবে নিসাব নয় এমন ব্যক্তির মান্নত করা ব্যতীত এবং কুরবানির পশু ক্রয় করার পূর্বে তার জন্য কুরবানি করা নফল থাকে)

যাদের কুরবানী ওয়াজিব;

মাসয়ালা ০১ ;

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মুকীম (মুসাফির নয়)  প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ই যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনাতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা পয়সা, সোনা রুপা, অলংঙ্কার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যাবসায়িক পন্য ও অপ্রোজনীয় সকল আসবাবপত্র কোরবানির নিসাব এর ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৩)

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি এবং রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি। টাকা বা অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্য সমপরিমাণ হাওয়া। আর স্বর্ণ বা রুপা বা টাকা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথক ভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্নতোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

মাসয়ালা ০২ ;

যাকাতের নিসাব থেকে কুরবানীর নিসাবের ভিন্নতা;

এক

যাকাতের নিসাব এর ক্ষেত্রে স্বর্ণ রুপা টাকা ও ব্যবসায়িক পণ্যের হিসাব করা হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র বর্ধনশীল সম্পদের হিসাব করা হয় আর যেগুলো বর্ধনশীল নয় যেমন জমি ,ফসল, গাড়ী ইত্যাদি এগুলোর হিসাব করা হয় না । পক্ষান্তরে কুরবানির হিসাবের ক্ষেত্রে সম্পদ বর্ধনশীল হোক বা বর্ধনশীল সকল প্রকার সম্পদের হিসাব করা হয়।

দুই

যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পর এক বছর অতিক্রম করতে হয়। পক্ষান্তরে কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে বছর অতিক্রম করা শর্ত নয়। বরং জিলহজের ১০ তারিখ ফজর থেকে১২ ই জিলহজ সূর্যাস্ত সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় নিসাবের মালিক হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে। বছর অতিক্রম হয়েছে কি হয়নি তা দেখা হবে না।
(আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫০৬)

মাসয়ালা০৩ ;

কোন নাবালেগ সন্তান যদি নেসাব পরিমান সম্পদের মালিক হয় এবং এই তিন দিনের মধ্যে সে প্রাপ্তবয়স্ক হয় তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
(বাদায়েউস সানায়ে৫/৬৪)

মাসয়ালা ০৪ ;

যে সমস্ত ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যায় আবার সুস্থ হয়ে যায় এ সকল ব্যক্তিরা যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং উক্ত তিন দিন সুস্থ থাকে তাহলে তাদের উপরে কোরবানি করা ওয়াজিব।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৪)

মাসয়ালা ০৫ ;

কোন ব্যক্তি বাড়ি ঘর নির্মাণ করার জন্য টাকা জমা রাখে কিন্তু কোন পণ্য ক্রয় না করে থাকে তেমনি ভাবে প্রয়োজন অতিরিক্ত ফসলের মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়ে যায় তাহলে তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

মাসয়ালা ০৬ ;

একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে প্রত্যেকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানী ওয়াজিব। পরিবারের যত সদস্যের উপর কুরবানী ওয়াজিব তাদের প্রত্যেকেই একটি করে পশু কোরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানির সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না।
(আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৩ ,ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৭/৩১২)

মাসয়ালা ০৭ ;

প্রয়োজন অতিরিক্ত জমি থাকলেও কুরবানী ওয়াজিব হয়।
(আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫০৬)

মাসয়ালা ০৮ ;

মে ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব তিনি নিজের পক্ষ থেকে কুরবানী করবেন অতঃপর সম্ভব হলে জিবীত বা মৃত পিতা-মাতা বা অন্যান্যদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিজের ওয়াজিব কুরবানী না করে অন্যান্য দের পক্ষ থেকে যেমন মৃত পিতা মাতা বা ছোট সন্তান তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়নি তাদের পক্ষ হয়ে কুরবানী করে । এটা সঠিক তরিকা নয় ।কারন এতে ঐ ব্যক্তির ওয়াজিব কুরবানী আদায় করা হয় না ।
(ফাতায়ায় মাহমুদিয়া ১৭/৩১২)

মাসয়ালা ০৮ ;

যে ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তি যদি কুরবানীর তিনদিনে কুরবানী না করে পশু বা তার মূল্য সদকা করে দেয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৬ ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৭/৩০৯)

মাসয়ালা ০৯ ;

কোন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পর কুরবানী আদায় না করে অতঃপর ঐ তিনদিন পর সে গরীব হয়ে যায় তাহলে ও তার উপর কুরবানী যোগ্য ছাগল সদকা করা আবশ্যক। দরিদ্র হওয়ার কারণে কুরবানী মাফ হবে না। সুতরাং সে আদায় করে যেতে না পারলে তা আদায় করে দেওয়ার জন্য ওসিয়ত করে যেতে হবে।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৫ আল ইখতিয়ার ৫/২০ মোবাইল শামেলা থেকে গৃহীত)

মাসয়ালা ১০ ;

কোন ধনী ব্যক্তি যদি কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে অতঃপর তা কুরবানী করার পূর্বেই তা হারিয়ে যায় ,বা মারা যায়,বা চুরি হয়ে যায় তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো অন্য একটি কুরবানী করা।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৬।কাযীখান ৩/৩৪৪আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫ ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

মাসয়ালা ১১ ;

কোন ধনী ব্যক্তি কোরবানির পশু হারিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় কোরবানি উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে অতঃপর পূর্বের হারিয়ে যাওয়া পশু ও পেয়ে যায় তাহলে তার জন্য উত্তম হলো উভয়টি কোরবানি করে দেওয়া। তবে সে চাইলে যে কোন একটি কোরবানি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে উভয় পশুর দামের মাঝে যদি তারতম্য থাকে তাহলে অতিরিক্ত অংশ সদকা করে দিবে।
(বাদায়েউস সানায়ে৫/৬৭ ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৭/৩১৭)

মাসায়ালা ১২ ;

কোন গরীব ব্যক্তি কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পর পূনরায় কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে অতঃপর পূর্বের হারিয়ে যাওয়া পশু পেয়ে যায় তাহলে তার জন্য উভয়টি কুরবানি করতে হবে, একটি পশু কুরবানি করা যথেষ্ট হবে না। তবে যদি গরিব ব্যক্তি দ্বিতীয় পশু ক্রয় করার সময় প্রথম পশুর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ক্রয় করে তাহলে এক্ষেত্রে একটি পশু কোরবানি করার যথেষ্ট হবে।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৭ আযীযুল ফাতাওয়া ৬৭৯)

মাসায়ালা ১৩ ;

কোন গরীব ব্যক্তি কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করার পর তা মারা যায় ,বা হারিয়ে যায়,বা চুরি হয়ে যায় তাহলে তার কুরবানী মাফ হয়ে যায় । এবং তার জন্য পূণরায় কুরবানীর ব্যবস্থা করা আবশ্যক নয়।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৬)

মাসয়ালা ১৪ ;

কোন ব্যক্তি যদি অন্য কারো অনুমতি নিয়ে তার পক্ষ হয়ে কোরবানি করে দেয় তাহলে ওই ব্যক্তির (তার জন্য কুরবানী করে দিচ্ছে) কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৭)

মাসয়ালা ১৫ ;

নাবালেগের কুরবানী;

নাবালক শিশু তদ্রূপ সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন নয় নিসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তাদের অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা দের পক্ষে নফল কুরবানী করতে পারবে।
(বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬ রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)

মাসয়ালা ১৫ ;

মুসাফির ব্যক্তির কোরবানীর বিধান;

যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮মাইল বা প্রায় ৭৮কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব।
ফাতাওয়া কাযিখান ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়েহ৪/১৯৫, হিদায়া ৪/৭৯, আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫)

মাসয়ালা ১৬ ;

কুরবানীর পূর্ণ সময়;

মোট তিন দিন কুরবানী করা যায়। জিলহজের ১০,১১,১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০তারিখে কুরবানী করা উত্তম।
(বাদায়েউস সানায়ে ৫/৮০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫, আল ইখতিয়ার ৫/১৯, মোবাইল শামেলা থেকে গৃহীত)

মাসয়ালা ১৭ ;

যে সমস্ত এলাকার লোকের উপরে জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করা বৈধ নয়।
হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত;
তিনি বলেন; নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; যে ব্যক্তি সলাত আদায়ের পুর্বে যবেহ্‌ করল সে নিজের জন্যই যবহ্‌ করল। আর যে ব্যক্তি সলাত আদায়ের পরে যবেহ্‌ করল, তার কুরবানী পূর্ণ হল এবং সে মুসলিমদের নীতি গ্রহণ করল।
(আধুনিক প্রকাশনী- ৫১৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫০৩৫, সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৫৪৬, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

মাসায়ালা ১৮ ;

অবশ্য বৃষ্টি বাদল বা অন্য কোনো ওজর যদি প্রথম দিনে ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাযের সময় শেষ হওয়ার পর( অর্থাৎ ঝাওয়ালের পর বা সূর্য মধ্য আকাশে থেকে বলে পড়ার পর) প্রথম দিনে কোরবানি করা জায়েজ।
(কাযীখান ৩/৩৪৪আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫ ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

মাসয়ালা ১৯ ;

১০ ও ১১তারিখ দিবগত রাতেও কুরবানী করা জায়েয।তবে দিনে কুরবানী করা ভালো।
(মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩, আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩২০, জাওহারাতুন নাইয়্যিরাহ ২/১৮৮)

মাসয়ালা ২০ ;

কোন গরীব গরিব ব্যক্তি কুরবানি করার পর কুরবানির তিনদিনের মধ্যে সাহিবে নিসাব হলে পূর্ণরায় কুরবানী ওয়াজিব হবে না।
(ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৫৩)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সহীহভাবে দ্বীন ইসলাম বোঝার তাওফিক দান করুন। এবং বেশি বেশি নেক আমল করার তাওফিক দান করুন।

এখানে মন্তব্য করুন

লেখক পরিচিতি

নামঃ মুহাম্মদ সালমান হুসাইন।
ইফতাঃ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ।
উলুমুল হাদিসঃ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
তাকমীলঃ ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
হিফজঃ ২০০৭ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া আরাবিয়া হাজী ইউনুস কওমী মাদ্রাসা।
শিক্ষকঃ হাজিপাড়া কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ

আমাদের অনুসরণ করুন

সর্বশেষ ইউটিউব ভিডিও

Play Video

সাম্প্রতিক পোস্ট

সাম্প্রতিক পৃষ্ঠা