
সূচিপত্র
ত্যাগ-কুরবানীর মহিমায় উজ্জীবিত হোক মুসলিম মিল্লাত
কুরবানী আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিধান এবং মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নাত। এটি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য মুসলিমদের নিবেদনের পরাকাষ্ঠা।
কুরবানী শব্দটি আরবী পরিভাষা। এর অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন, নৈকট্য লাভ ইত্যাদি। এর কয়েকটি আরবী প্রতিশব্দ হল উযহিয়্যা, যবীহা, নহর।
পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জিলহাজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সামর্থবান প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাকে কুরবানী বলা হয়।
কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদের সকলেরই জানা আবশ্যক। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিম মিল্লাতে পশু কুরবানীর ধারা প্রচলিত হয়। এ ধারার প্রথম প্রবর্তক ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও নবী আদম আ. এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
“আপনি তাদেরকে আদমের দু’পুত্রের কাহিনী যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়ে কুরবানী নিবেদন করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অপরজনের কবুল হল না। সে কাবিল বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই তা গ্রহণ করেন।”
(সূরাহ মায়িদাহ: ২৭)
এখানে দেখা যায়, হাবিল তাকওয়ার অধিকারী হওয়ার কারণে তার কুরবানীকৃত দুম্বা আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় এবং কাবিল অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যে শস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মিভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। এ নিয়মানুযায়ী কুরবানী যেমন ছিল তেমনি পড়ে থাকত।
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পৃথিবীতে যত শরী‘আত প্রবর্তিত হয়েছে সকল শরী‘আতেই কুরবানীর বিধান বিদ্যমান ছিল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوْا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ بَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوْا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব, তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।”
(সূরাহ হাজ্জ: ৩৪)
কিন্তু প্রত্যেক শরী‘আতেই কুরবানীর পদ্ধতিগত পার্থক্য ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, নূহ আ. পশু যবেহ করার জন্য একটি কুরবানী গাহ্ নির্মাণ করেন, যেখানে তিনি তাঁর শরী‘আত অনুযায়ী যবেহকৃত পশুকে আগুনে জ্বালিয়ে দিতেন। এছাড়া অন্যান্য ধর্মেও উৎসর্গের প্রচলন ছিল।
হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, “অমাবশ্যাতে (দর্শ) গো-বৎস বলি দিয়ে ব্রত পালন করব”
(ঋগ্বেদ)
চিনাদের মধ্যেও কিংফুজীর আবির্ভাবের পূর্বে উৎসর্গের প্রচলন ব্যাপক ও সার্বজনীন ছিল। গ্রীক ও রোমানরা গো-বৎস, শূকরছানা ও মদ দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত। নীলনদের তীরবর্তী অধিবাসীরা ইসলামী খিলাফতের শাসনাধীনে আসার পূর্ব পর্যন্ত নীল নদের অনুকম্পা লাভের উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক কিশোরীর রক্ত উৎসর্গের ব্যবস্থা করত। জাহিলী যুগে আরবরাও বিভিন্ন দেবতার নামে কুরবানী করত।
মূলত কুরবানীর পেছনে রয়েছে চরম আত্মত্যাগের এক কালজয়ী ইতিহাস। এটি ইবরাহীম আ. এর ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। প্রতি বছর মুসলিমগণ যে কুরবানী করে থাকে সেটি ইবরাহীম আ. এর কুরবানীরই স্মৃতিচারণ। তিনি ছিলেন বর্তমান পৃথিবীর তিনটি বৃহৎ জাতি মুসলিম, ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান এর অনুসারীদের নিকট সমভাবে সম্মানিত। তিনটি জাতির লোকেরাই তাঁকে আল্লাহর নবী হিসেবে স্বীকার করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مِّلَّةَ أَبِيْكُمْ إِبْرَاهِيْمَ
“তোমাদের জাতির পিতা হল ইবরাহীম।”
(সূরাহ হাজ্জ: ৭৮)
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকের একটি পৌত্তলিক পরিবারে ইবরাহীম আ. জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। শাসকগণ জনসাধারণকে দাস বানিয়ে রেখেছিল। রাজা-বাদশাগণ ছিল সমাজের প্রভু। সাধারণ জনগণের কোন বাক স্বাধীনতা ছিলনা। জীবনের কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। শাসকদের মুখের কথাই ছিল আইন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মূর্তিপূজার সয়লাব বয়ে গিয়েছিল। এছাড়া তারা সূর্য ও নক্ষত্রের পূজাও করত। ইবরাহীম আ. এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
তিনি ঘোষণা করেন,
يَا قَوْمِ إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ
“হে জাতির লোকেরা! তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
(সূরাহ আন‘আম: ৭৮)
মুসলিম জাতির জনক ইবরাহীম আ. মূর্তি পূজারীদের নিকট ইসলামের সুমহান আদর্শ উপস্থাপন করেন। তিনি লোকদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহবান জানান।
তিনি তাঁর পিতাকে বলেন,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لِأَبِيْهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِيْ ضَلالٍ مُّبِيْنٍ
“আর যখন ইবরাহীম আ. স্বীয় পিতা আযরকে বললেন, আপনি কি মূর্তিকে খোদা মানেন? আমিতো দেখছি আপনি আর আপনার জাতির লোকেরা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত।” (সূরাহ আন‘আম: ৭৪)
তিনি তাঁর পিতাকে আরও বলেন,
إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا (42
يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا (43
يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا (44
يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا (45
“হে আমার পিতা! আপনি কেন সেসব জিনিসের ইবাদাত করেন, যেগুলো শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকার করতে পারে না ? হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা আপনার কাছে আসেনি। সুতরাং আমার অনুসরণ করুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদাত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি আশংকা করি দয়াময়ের একটি আযাব এসে আপনাকে স্পর্শ করবে, এরপর আপনি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবেন।”
(সূরাহ মারইয়াম: ৪২-৪৫)
ইবরাহীম আ. যখন তাঁর পিতাকে এভাবে সত্য পথে চলার আহবান জানালেন, তখন সে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল এবং তাঁকে পাথর মেরে হত্যার হুমকি দিল। তাঁর পিতা তাকে বলল,
أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيْمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا
“হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তাহলে আমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও।”
(সূরাহ মারইয়াম: ৪৬)
ইবরাহীম আ. ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক। পিতার চোখ রাঙানীকে তিনি ভয় পাননি। তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তেজদ্বীপ্ত বেগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। মানবরচিত মতবাদের অসারতা প্রমাণ করার জন্য তিনি তাদের তৈরি করা মূর্তিগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙ্গে ফেলেন। এতে তৎকালীন পৌত্তলিক গোষ্ঠী গোস্বায় ফেটে পড়ে। তারা তাঁকে জনসমক্ষে উপস্থিত করে জিজ্ঞেস করে,
قَالُوا أَأَنتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيْمُ- قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيْرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوْهُمْ إِن كَانُوا يَنْطِقُوْنَ-فَرَجَعُوْا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوْا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُوْنَ-ثُمَّ نُكِسُوْا عَلَى رُؤُوْسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلاء يَنْطِقُوْنَ-قَالَ أَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلا يَضُرُّكُمْ- أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَفَلاَ تَعْقِلُوْنَ-
“হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তিনি বললেন, না, এদের প্রধানই তো এ কাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে। এরপর তারা মনে মনে চিন্তা করল এবং বলল, লোকসকল! তোমরাই বেইনসাফ। এরপর তারা ঝুকে গেল মস্তক অবনত করে; তুমি তো জান যে এর কথা বলে না। তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদাত কর, যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারেনা? ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত কর ওদের জন্য। তোমরা কি বোঝ না?”
(সূরাহ আম্বিয়া: ৬২-৬৭)
ইবরাহীম আ. এর দুঃসাহসিক কাজের জন্য বাদশাহ নমরূদ তাঁকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে উদ্যত হয়। তাঁকে গ্রেফতার করে রাজদরবারে আনা হয়। তখন ইবরাহীম আ. তাকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। কিন্তু নমরূদ তখন তাঁর সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হয়।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ قَالَ أَنَا أُحْيِيْ وَأُمِيْتُ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ فَإِنَّ اللهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ
“ইবরাহীম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিও জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইবরাহীম বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, এবার তুমি একে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না।”
(সূরাহ বাকারাহ: ২৫৮)
ইবরাহীম আ. যুক্তির মাধ্যমে মূর্তিকে খোদা মানার অসারতা প্রমাণ করলেন। কিন্তু নমরূদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কিছুতেই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি। বরং নৈতিকভাবে ইবরাহীম আ. এর নিকট পরাজিত হয়ে তারা তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা অন্ধ বর্বরতায় মেতে উঠে। তাঁরা তাকে প্রথমে দশদিন কারাগারে বন্দী করে রাখে এবং পরবর্তীতে পুড়িয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
قَالُوا حَرِّقُوْهُ وَانصُرُوْا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ
“তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও।”
(সূরাহ আম্বিয়া: ৬৮)
ইবরাহীম আ. এর সংগ্রামী জীবনে এটি ছিল প্রথম পরীক্ষা। তাঁকে যখন অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি তাদের কাছে নতিস্বীকার করেননি। জীবন ভিক্ষা চাননি। জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের দীন ও ঈমান ত্যাগ করেননি। তারা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নিজেদের তৈরি করা নরকে নিক্ষেপ করল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি এ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْنَا يَا نَارُ كُوْنِي بَرْدًا وَسَلامًا عَلَى إِبْرَاهِيْمَ- وَأَرَادُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الأَخْسَرِيْنَ
“আমি বললাম, হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের প্রতি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে ফন্দী আঁটতে চাইল। অতঃপর আমি তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।”
(সূরাহ আম্বিয়া: ৬৯-৭০)
অগ্নিকু- থেকে রক্ষা পেয়ে ইবরাহীম আ. আল্লাহর পথে ফিরে আসার জন্য পুনরায় তাদেরকে আহবান জানান। কিন্তু তারা কিছুতেই নিজেদের পূর্ব পুরুষদের ভুল পথ পরিত্যাগ করতে রাজি হয়নি। এরপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِيْنِ
“সে বলল, আমার পালনকর্তার দিকে চললাম, তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন।”
(সূরাহ সাফফাত: ৯৯)
নিজের স্ত্রী সারাহ এবং ভাতিজা লূত আ. কে সাথে নিয়ে তিনি পর্যায়ক্রমে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরে হিজরত করেন। তৎকালীন মিসরের বাদশাহ ছিল স্বৈরাচারী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ ইবরাহীম আ. ও তাঁর স্ত্রীর ব্যবহারে মগ্ধ হয়ে স্বীয় কন্যা হাজেরাকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। মিসর থেকে ইবরাহীম আ. পুনরায় ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। এ সময় ভাতিজা লূত আ. কে তিনি জর্ডান এলাকায় নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকেও নবুওয়াত দান করেন।
ইবরাহীম আ. বৃদ্ধাবস্থায় এসে উপনীত হলেন। প্রথম স্ত্রী সারাহ বন্ধা হওয়ায় কোন সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি চিন্তিত হলেন, ভাবলেন, আমার ইন্তিকালের পর দীনের এ গুরু দায়িত্ব কে পালন করবে? এজন্য তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন,
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِيْنَ
“হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এক পুত্র সন্তান দান কর।”
(সূরাহ সাফফাত: ১০০)
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। তাঁর বয়স যখন ৮৬ বছর, তখন স্ত্রী হাজেরার গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيْمٍ
“সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।”
(সূরাহ সাফফাত: ১০১)
ইবরাহীম আ. পুত্রের নাম রাখলেন ইসমাঈল। বৃদ্ধ বয়সে শিশু পুত্রের হাসিতে তাঁর মন ভরে উঠে। কিন্তু এ পুত্রের ভালবাসা নিয়ে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চান যে, তিনি পুত্রের প্রতি ভালবাসার চেয়ে আল্লাহর হুকুম পালনে বদ্ধ পরিকর কি না? এবার আল্লাহ ইসমাঈল আ. ও তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার জনমানব ও ফল পানি শস্যহীন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। ইবরাহীম আ. তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত হন। তিনি স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর ইঙ্গিতে তিনি তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে এক মশক পানি ও কিছু খেজুর দিয়ে আবার ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি একটি বারও চিন্তা করেননি এ পরীক্ষার কারণ কি, কি উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এদের নিরাপত্তা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কিভাবে হবে? স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষণ পিছু পিছু দৌঁড়ালেন। কোন কিছুর মায়াই তাঁকে থমকে দিতে পারেনি। দুঃশ্চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। কি করুন হৃদয় বিদারক দৃশ্য। প্রশান্ত মহাসগরের মত প্রশস্ত হৃদয় আর হিমালয়ের মত অটল ধৈর্যশীল ইবরাহীম আ. সাফল্যের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
ইবরাহীম আ. দীনের দা‘ওয়াত নিয়ে ঘুরে বেড়ান ফিলিস্তিন, জর্ডান ও হিজাজের বিভিন্ন এলাকায়। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি মাঝে মাঝে স্ত্রী-পুত্রকে দেখার জন্য মক্কায় যাতায়াত করেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ছেলে বেড়ে উঠে। ছেলের প্রতি ইবরাহীম আ. এর মহব্বতও তুঙ্গে উঠে। সংসারে আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হয়। ঠিক এমনই এক মুহূর্তে ধৈর্যের দরজায় কড়া নেড়ে উপস্থিত হয় আর এক অগ্নি পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নের মাধ্যমে ইবরাহীমকে নির্দেশ দেন ইসমাঈলকে কুরবানী করার জন্য। পুত্রের প্রতি ভালবাসার বন্ধন ইবরাহীমকে আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি নির্ভীক চিত্তে আল্লাহর হুকুম পালনে প্রস্তুত হন। এ ঘটনাকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে পৃথিবীবাসীর জন্য চিরজাগরুক করে রেখেছেন,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّيْ أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّيْ أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْ إِنْ شَاء اللهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيْمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاء الْمُبِيْنُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ
“অনন্তর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তাকে যবেহ করার জন্য শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটি এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার এক মহান জন্তু।” (সূরাহ সাফফাত: ১০২-১০৭)
ইবরাহীম আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দুম্বাটিকে যবেহ করে দিলেন। প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীমের ঐ বিরাট কুরবানীকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য মুসলিদের মাঝে প্রতি বছর কুরবানী করার নিয়ম চালু করে দিলেন। আজ ও আমরা ইবরাহীম আ. এর সে মহান কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিবছর পশু কুরবানী করি। এভাবে আল্লাহ ইবরাহীম আ. কে কালের সাক্ষী এক মহা পুরুষ বানিয়েছেন।
ইবরাহীম আ. মুসলিম জাতির গর্ব। আমরা তাঁর গর্বিত সন্তান। কিন্তু ইবরাহীম আ. এর গর্বিত সন্তানরা আজ সীমাহীন মতপার্থক্যে লিপ্ত। পিতার আদর্শ বঞ্চিত সন্তানরা দীর্ঘদিন থেকে শুধু যে পিতৃ শিক্ষা থেকে বিস্মৃত হয়ে আছে, কেবল তাই নয়; বরং তাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ও হানাহানিতে আজকের বিশ্বশান্তি চরমভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অশান্তির বিষাক্ত দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে বিশ্ব সমাজকে ছারখার করে দিচ্ছে। এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আজকের বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতকে ইবরাহীম আ. এর ত্যাগ-কুরবানীর আদর্শে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উজ্জীবিত হতে হবে। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দীনের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই সম্ভব কুরআন-সুন্নাহর আলোকে একটি পরিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর এ সম্ভাবনাকে কোন শক্তিই প্রতিহত করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন!!
এখানে মন্তব্য করুন
লেখক পরিচিতি
নামঃ ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী।
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
বি. এ (অনার্স), (১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষ),
এম. এ, (১৯৯৯ শিক্ষাবর্ষ),
পিএইচ.ডি, (২০০৬ শিক্ষাবর্ষ), ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
পেশাঃ সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০১৭১৮ -৫৭৭১২২
ই-মেইলঃ dfas122@gmail.com