মোহর মূলত একটি সম্মাননা, যা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে প্রদান করে থাকে, যার উদ্দেশ্য হলো স্ত্রীকে সম্মান করা। এটি স্ত্রীর মূল্য নয়, তা উসুল করে স্ত্রী স্বামীর হাতে বিক্রি হয়ে যায়।
মোহর এর তাৎপর্য

সূচিপত্র

মোহরানার তাৎপর্য

মোহর মূলত একটি সম্মাননা, যা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে প্রদান করে থাকে, যার উদ্দেশ্য হলো স্ত্রীকে সম্মান করা। এটি স্ত্রীর মূল্য নয় যে, তা উসুল করার মাধ্যমে স্ত্রী স্বামীর হাতে বিক্রি হয়ে যায়। এটি আবার কোন কাল্পনিক দায়িত্ব নয়, যার সম্পর্কে এরূপ ধারণা করার অবকাশ রয়েছে যে, তা পরিশোধ করার কোন আবশ্যকতা নেই । স্বামীর দায়িত্বে স্ত্রীর মোহরা আবশ্যকীয় করার দ্বারা শরীয়তের উদ্দেশ্য এই যে, যখন কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে নিজ গৃহে নিয়ে আসবে তখন তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে নিয়ে আসবে এবং সে জন্য তাকে এমন একটি হাদিয়া প্রদান করবে যা দ্বারা তার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন হয়। আর তাই শরীয়াতের দাবি হলো এই যে, মোহরের পরিমাণ এত অল্প ও নির্ধারণ করবে না যার দ্বারা মোটেও সম্মান প্রদর্শন হয় না, আবার এত অধিক পরিমাণে নির্ধারণ করবে না, যা স্বামী পরিশোধ করার ক্ষমতা রাখে না। ফলে শেষ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর মোহর অনাদায়ী রেখেই দুনিয়া থেকে চলে যায় অথবা আদায় না করতে পারার কারণে স্ত্রীর থেকে মাফ চেয়ে নিতে বাধ্য হয় ‌।

মোহরের ক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টি ভঙ্গি;

শরীয়তের দৃষ্টিতে মহরে মিসল এক নারীর অধিকার, প্রত্যেক নারীর প্রকৃত অধিকার অর্থাৎ মোহরে মিসল দ্বারা মোহরের এ পরিমাণ উদ্দেশ্য, যা সে বংশীয় তার মত অন্যান্য নারীদের বিয়েতে সাধারণত মোহর হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি তার মত নারী না থাকে তাহলে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের যে সকল নারী রয়েছে তাদের সাধারণত  যে মোহর নির্ধারণ করা হয়, তা বিবেচিত হবে। তাই এতে শরীয়াতের দৃষ্টিতে প্রতিটি নারী তার বিবাহের সময়ে মোহরে মিসকল দাবি করার অধিকার রাখে। আর এ কারণেই যদি বিবাহের সময়ে মোহর নির্ধারন না করা হয় কিংবা মোহরের উল্লেখ করা ছাড়াই বিবাহ সম্পন্ন হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মোহরে মিসল ওয়াজিব হয়ে যায় । শরীয়তের বিধান অনুযায়ী এক্ষেত্রে স্ত্রীকে মোহরে মিসল প্রদান করা স্বামীর দায়িত্ব জরুরি হয়ে পড়ে। অবশ্যই স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় মহরে মিসল থেকে কম নিতে রাজি হয় অথবা স্বামী যদি স্বেচ্ছায় মোহরে মিসল থেকে বেশি দিতে রাজি হয় তাহলে উভয় পক্ষের সম্মতিতে তাও হতে পারে। শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বৈধ আছে।

মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ;

শরীয়াতে মোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি বরং তা উভয় পক্ষের সম্মতি উপর রেখে দিয়েছে। তবে শরীয়ত মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর তা হল ১০ দিরহাম বা দুই তোলা এবং সাড়ে সাত মাসা রুপা। বর্তমান প্রচলিত ওজন হিসাবে ৩০.৬১৮। এ হলো মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ অর্থাৎ এর চেয়ে কম মোহরে স্ত্রী রাজি হলেও শরীয়ত মোহর হিসাবে গণ্য করে না। কেননা এর চেয়ে কম পরিমাণ মহরে মূলত মোহরের মূল উদ্দেশ্য (স্ত্রীর সম্মান হাসিল হয় না)। মোহরের এই সর্বনিম্ন পরিমাণও  ঐ সকল ব্যক্তিদের প্রতি খেয়াল করে করা হয়েছে যারা আর্থিকভাবে দুর্বল ও অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য যাদের নেই। তাই তাদের জন্য এই সুযোগ রাখা হয়েছে যে, স্ত্রী সম্মত থাকলে এতোটুকু পরিমাণ মোহর হিসাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। কিন্তু এর এই অর্থ নয় যে, শরীয়ত মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণকে উত্তম ঘোষণা করেছে বা আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বনিম্ন পরিমাণে পছন্দ বলে আখ্যায়িত করেছে।

মোহরের ফাতেমী;

মোহরে ফাতেমীর মূল হলো; হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু বিবাহের সময়ে হযরত ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার সময়ে যে মোহর দিয়েছিলেন, তাকে মোহরে ফাতেমী বলা হয়। এটা সকলের নিকটই প্রসিদ্ধ যে হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু বিবাহের সময় মোহর হিসাবে একটি বর্ম দিয়েছিলেন। দিরহাম নয় ।

একটি হাদিসে এসেছে

حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ الطَّالْقَانِيُّ، حَدَّثَنَا عَبْدَةُ، حَدَّثَنَا سَعِيدٌ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا تَزَوَّجَ عَلِيٌّ فَاطِمَةَ قَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ أَعْطِهَا شَيْئًا ‏”‏ ‏.‏ قَالَ مَا عِنْدِي شَىْءٌ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ أَيْنَ دِرْعُكَ الْحُطَمِيَّةُ ‏”‏ ‏.‏

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন; যখন ‘আলী (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন; তাকে কিছু প্রদান করো। তিনি বললেন, আমার নিকট কিছুই নেই। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন; তোমার হুতামীয়া বর্মটি কোথায়? (সেটাই দাও)।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২১২৫)

হযরত ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার মোহর নির্দিষ্ট ছিল আর তা হলো আলী রাযিআল্লাহু-এর  বর্ম। কিন্তু তার মূল্য কত ছিল এ ব্যপারে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। যার সারকথা হলো; কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায় ১২ উকিয়া বা ৪৮০ দিরহাম
বা ১২৬ ভরি বা ১৪৬৯.৬৬৪ গ্রাম রুপা

وأما الدرع الحطيمة التي أمهرها علي رضي الله عنه فاطمة الزهراء بنت النبي صلى الله عليه وسلم فقد كانت قيمتها أربعمائة درهم، وورد أربعمائة وثمانون درهما كما عند ابن سعد في طبقاته وأبي يعلى وغيرهما، وذلك هو ما يساوي: اثنتي عشرة أوقية الواردة في خبر عمر، لأن الأوقية أربعون درهما، فتكون الاثنتا عشرة أوقية: أربعمائة وثمانين درهما

এ বর্ণনাকে অনেকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আর কোন‌কোন বর্ণনায় ১২ উকিয়া ও এক উকিয়ার অর্ধেক বা‌ ৫০০ দিরহাম বা ১৩১ ভরি।
ইতিপূর্বেই আমরা বলে এসেছি যে, মোহরর ক্ষেত্রে মূল হলো মোহরে মিসল। কিন্তু যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার যে মোহর নির্ধারণ করেছিলেন তাই কেউ যদি বরকতের আসায় তা নির্ধারণ করতে চায় তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং বহু ওলামায়ে কেরাম বিবাহের ক্ষেত্রে মহরে ফাতেমীকে মুস্তাহাব বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মোহরের বিষয়ে সমাজে প্রচলিত কিছু ভ্রান্তি;

  • ১) অনেকে মোহরের ফাতেমীকে শরয়ী মোহর হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন।
    অন্য কোন মোহর নির্ধারণ করতে রাযী নন। এমনকি বর পক্ষ এতে রাযী না হলে বিবাহের জন্য সম্মত হন না ।অথচ তাদের ও জানা আছে যে, ছেলে এই পরিমাণ মোহর আদায় করতে পারবেন না ।এটা নিছক বাড়াবাড়ি। এমন কাজ পরিহার করা আবশ্যক। তাদের এ পিড়াপাড়ি দ্বারা মনে হয় এর চেয়ে কম বা বেশি মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় । যা নিতান্তই ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে বিরুপ ধারণা ফেলে।
    তবে হাঁ ,যদি উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমীর পরিমাণ নির্ধারণ করে এবং এ নিয়ত থাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারণকৃত পরিমাণটি বরকতপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ। সেজন্যই তা নির্ধারণ করা হচ্ছে । তাছাড়া এতে ইত্তবায়ে সুন্নাতের সওয়াব ও আশা করা যায়।
  • ২) বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত মোহর লেখা হয়।
  • (ক) অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোক দেখানোর জন্য বা লোকে কী বলবে এজন্য মোহর বেশি রাখা হয়। অথচ চিন্তা ও করা হয় না যে, ছেলে তা আদায় করতে সক্ষম কিনা?
  • খ) আমাদের দেশে নিয়ম হলো কোন কারনে স্ত্রীকে তালাক দিলে ঐ লিখিত মোহর আদায়ের জন্য আদালত থেকে চাপ প্রয়োগ করে। তাই যদি ভবিষ্যতে কখনো এমন হয় যে, মেয়েপক্ষ বেশি আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে পারে । আর এজন্য অনেক সময় মোহর নিয়ে দর কষাকষি চলে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় , এমনকি অনেক বিয়ে ভেঙ্গে যায়। অথচ এ সকল লোকের একটু ভাবা দরকার, বিবাহ একটি দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের নাম বা আজীবন সম্পর্কের নাম। তাই শুরুতে বিবাহ বিচ্ছেদের চিন্তা না করা কাম্য।
  • ৩) বিবাহের সময়ে মে মোহর লেখা হয় কাজী সাহেব বিবাহ রেজিস্ট্রার খাতায় উক্ত কলামে গদবাধা লিখে দেন যে, একতৃতীয়াংশ আদায়, একতৃতীয়াংশ মোহরে মুয়াজ্জাল ও একতৃতীয়াংশ মুআজ্জাল। অথচ বাস্তবে কোন বিষয়েরই খেয়াল করা হয় না । ভুলে যায় যে এটা স্ত্রীর হক। তাই সে কি পরিমান বুঝে পেল তার প্রতি কড়া নজর রাখা উচিত।

মোহর কোন প্রথাগত বিষয় নয়;

মোহর নির্ধরন কোন প্রথাগত বিষয় নয় যে, চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তা নির্ধারণ করা হবে এবং কার্যত তার বাস্তবায়ন করা হবে না বরং তা একটি শরয়ী বিধান। যা পালনে পূর্ণ সতর্ক বিবেচনার দাবি রাখে। আর যেহেতু এটি একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, তাই সব দিক থেকে সুস্পষ্ট হতে হবে এবং সে অনুযায়ী তা আদায় করতে ও চেষ্টা করতে হবে । কেননা তা স্ত্রীর একক হক।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বিষয়টি বোঝার তাওফিক দান করুন।

এখানে মন্তব্য করুন

লেখক পরিচিতি

নামঃ মুহাম্মদ সালমান হুসাইন।
ইফতাঃ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ।
উলুমুল হাদিসঃ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
তাকমীলঃ ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
হিফজঃ ২০০৭ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া আরাবিয়া হাজী ইউনুস কওমী মাদ্রাসা।
সিনিয়র শিক্ষকঃ হাজিপাড়া কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ

আমাদের অনুসরণ করুন

সর্বশেষ ইউটিউব ভিডিও

Play Video

সাম্প্রতিক পোস্ট

সাম্প্রতিক পৃষ্ঠা